বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তৈরির প্রকৃত ইতিহাস, পতাকা আইন সম্পর্কে জানা অজানা কিছু ।

"১৯৬৯ সাল। ঢাকা সেনানিবাসের ১৪ পদাতিক বাহিনীর সদর দফতরে স্থাপিত ট্রাইবুনালে তখন বিচার চলছিল তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার’ আসামিদের। ’৬৯-এর চলমান ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানি সামরিকচক্র যখন বুঝতে পারল এই মিথ্যা প্রহসনের মামলা আর চালিয়ে যেতে পারবে না তখনই তারা সামরিক ব্যারাকে বন্দি সার্জেন্ট জহুরুল হককে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। অজুহাত তিনি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। সেদিন ছিল ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী। 

আমরা যারা সেদিন রাজপথে আন্দোলন করছিলাম এবং বুকের মাঝে এক স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন লালন করছিলাম তাদের কাছে সার্জেন্ট জহুরুল হকের হত্যাকাণ্ড ছিল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দামামা। ইতোমধ্যে ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের তোড়ে ভেস্তে যায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পাতানো বিচারের খেলা। বাংলার সংগ্রামী জনতা তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ছিনিয়ে আনে কারাগার থেকে। পাকিস্তানি সেনা প্রশাসনের এ পরাজয়ের পটভূমিতে ক্ষমতার হাত-বদল হলো আর একবার। ১৯৬৯-এর ২৫ মার্চ আইয়ুব খানের স্থলাভিষিক্ত হলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। জারি করলেন ফের মার্শাল ল’। সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ হলো। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ছিল একটি নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে ১১ দফা

আন্দোলনের মাধ্যমে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করে। এ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের আড়ালে ছাত্রলীগের একটি হার্ডকোর গ্রুপ সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। শিবুদা, আমি ও আরো অনেকে এ গ্রুপে সক্রিয় ছিলাম। প্রয়াত কাজী আরেফ আহমেদ ছিলেন সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। ইয়াহিয়ার মার্শাল ল’ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বন্ধ করলেও ছাত্রলীগের এ হার্ডকোর গ্র“পের প্রস্তুতি থাকে অব্যাহত। সার্জেন্ট জহুরুল হকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের দিন স্মরণে আমরা গঠন করলাম ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যে পরিকল্পিত প্রথম সশস্ত্রবাহিনী।

১৯৬৯-এর শেষের দিকে ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। তদনুযায়ী ’৭০-এর জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করেন ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস ৭ জুন। ঐ দিন রেসকোর্স ময়দানে প্রথম নির্বাচনি সভার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ঐ দিন পল্টন ময়দানে (রেসকোর্সে সভার আগে) কুচকাওয়াজের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে বাহিনী পতাকা (রেজিমেন্টাল কালার) গ্রহণ করে ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করবে। 

শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি। ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কাঠামোয় লালিত বিপুলসংখ্যক হার্ডকোর সদস্য তৈরি করা হলো ৭ জুন ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) থেকে মিছিল করে পল্টন ময়দানে যাওয়ার জন্য। এখন প্রশ্ন হলো কেমন হবে বাহিনী পতাকা। এই বাহিনীর সঙ্গে নেতৃস্থানীয় যারা জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে আসম আব্দুর রব, কাজী আরেফ আহমেদ, শেখ শহিদুল ইসলাম, মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি), হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, চিশতি শাহ্ হেলালুর রহমান, মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশ, শিবনারায়ণ দাস, আব্দুল্লাহ সানি, মইনুল ইসলাম চৌধুরী, গোলাম ফারুক, ফিরোজ শাহ্, খসরু ভাই (পুরো নাম মনে নেই) উল্লেখযোগ্য। পতাকা তৈরি নিয়ে মিটিংয়ে বসলাম আমরা ইকবাল হলের ১০৮ নং কক্ষে।

এ কক্ষটি বরাদ্দ ছিল তৎকালীন ছাত্রনেতা আসম আব্দুর রবের নামে। কাজী আরেফ আহমেদের প্রস্তাব অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হলো পতাকায় সবুজ জমিনের ওপর থাকবে একটি লাল বৃত্ত, আর লাল বৃত্তের মাঝে থাকবে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। সবুজ জমিন বাংলার চির সবুজের প্রতীক, লাল সূর্য রক্তে রাঙা হয়ে উঠবে স্বাধীনতার সূর্য আর জন্ম নেবে একটি নতুন দেশ সোনালি আঁশের রঙে হবে তার পরিচয়। লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনালি রঙ্গের মানচিত্র তারই প্রতীক। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবাই কাজে নেমে পড়লাম। খসরু ভাই গেল তখন বলাকা সিনেমা হলের চারতলায় এক বিহারি দরজির দোকানে। বড় এক টুকরা সবুজ কাপড়ের মাঝে সেলাই করে আনলেন লাল বৃত্তাকার সূর্যের প্রতীক। এখন হলো আরেক সমস্যা। পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। সিদ্ধান্ত হলো ওটা লাল বৃত্তের মাঝে রঙ দিয়ে আঁকা হবে। আঁকাআঁকিতে কুমিল্লার শিবুদার হাত ছিল ভালো। তিনি বললেন ‘আমি বাপু পেইন্ট করতে পারব, তবে মানচিত্র আঁকতে আমি পারব না’। কী করা যায়? ঠিক করলাম হাসানুল হক ইনু আর আমি পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র ট্রেসিং পেপারে ট্রেস করে নিয়ে আসব।

আমরা গেলাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন জিন্নাহ্ হলে (বর্তমানে তিতুমীর হল)। উল্লেখ্য, আমি এবং ইনু ভাই উভয়েই তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। জিন্নাহ্ হলে ৪০৮ নং কক্ষে থাকেন এনামুল হক (ইনু ভাইয়ের কাজিন)। তার কাছ থেকে অ্যাটলাস নিলাম। ট্রেসিং পেপারে আঁকলাম পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। নিয়ে এলাম ইকবাল হলের ১০৮নং কক্ষে। বাকি সবাই সেখানে অপেক্ষা করছিল। শিবুদা তার নিপুণ হাতে ট্রেসিং পেপার থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র আঁকলেন লাল বৃত্তের মাঝে। তাতে দিলেন সোনালি রঙ। তৈরি হয়ে গেল ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনীর পতাকা।
পরদিন অর্থাৎ ৭ জুন আমরা আসম আব্দুর রব ও শেখ শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে সুশৃঙ্খল মিছিল নিয়ে ইকবাল হল থেকে গেলাম পল্টন ময়দানে। সেখানে মঞ্চে দাঁড়ানো ‘বঙ্গবন্ধু ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’র অভিবাদন গ্রহণ করলেন এবং বাহিনীর পক্ষে আসম আব্দুর রব ইকবাল হলের ১০৮ নং কক্ষে তৈরি পতাকা বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে গ্রহণ করলেন আনুষ্ঠানিকভাবে। এই সেই পতাকা যা উড়ল বাংলার ঘরে ঘরে স্বাধীন বাংলার পতাকা হয়ে। এই পতাকাটিই ১৯৭১ সালে ছাত্রনেতা শাজাহান সিরাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে বিশাল ছাত্র জমায়েতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে ঘোষণা দেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ পতাকা থেকে বাংলাদেশের মানচিত্রটি বাদ দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আমি এখানে যাদের নাম উল্লেখ করেছি তাদের মাঝে যারা আজো বেঁচে আছেন তারা এই ইতিহাসের সাক্ষী।
লিখার সুত্র:
ইউসূফ সালাহউদ্দীন আহমদ
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী 


ফুটবল বিশ্বকাপ ও বিদেশী পতাকা উত্তোলন বিষয়ক আইন 

অনেক আইনসিদ্ধ নিয়মের মধ্যে একটা হচ্ছে- বিদেশী পতাকা বাংলাদেশে অবস্থিত সেই দেশের কাউন্সিলর অফিস, প্রধান ডিপ্লোম্যাটিক মিশন এবং তাদের আবাসিক স্থানে উত্তোলন করতে পারবে। বিদেশী কোন রাষ্ট্র প্রধান, প্রধানমন্ত্রী অথবা কোন মন্ত্রী সফরকালে তাদের যদি রীতি থাকে তবে কারে বা বিমানে জাতীয় পতাকা উড়াতে পারবে। এছাড়া বাংলাদেশে অবস্থিত কোন দূতাবাসে তাদের রাষ্ট্রীয় দিবসে বিদেশী পতাকা উত্তোলন করতে পারবে সেক্ষেত্রে একই সাথে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে হবে। জোড় সংখ্যক পতাকা হলে বাংলাদেশের পতাকা সামনে থেকে ডানদিকে রাখতে হবে এবং বিজোড় সংখ্যক হলে বাংলাদেশের পতাকা মাঝখানে রাখতে হবে।
উপরের সকল ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সেই সকল দেশ সুবিধা পাবে যারা অনুরূপ সুবিধা বাংলাদেশের জন্য রেখেছে। অন্যথায় কোন অবস্থাতেই বিদেশী পতাকা বাংলাদেশের কোন ভবন বা অফিসে বা অন্য কোথাও উত্তোলন করা যাবে না।
এবার আসল আলোচনায় আসি। সামনে বিশ্বকাপ ফুটবল।

এই উপলক্ষে অনেকে ঘরে থাকা গত বিশ্বকাপের পতাকা খুঁজে বের করা শুরু করেছে। অনেকে আবার অগ্রিম দর্জিকে অর্ডার দিয়ে রেখেছে তার ফেভারিট দেশের পতাকার জন্য। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকে এসব পতাকা ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের প্রতিটা শহরে অনেক বাড়িতে উড়তে থাকে। খেলা শেষ হয়ে গেলেও অনেক বাড়িতে মাসাধিককাল এই পতাকাগুলি উড়তে দেখা যায়। অথচ নিজের দেশের পতাকা কি মাপের এবং কিভাবে হলো এসব হয়তো জানে না এবং পতাকার কি গুরুত্ব তা পর্যন্ত জানে না এমনই অনেকে বিদেশী পতাকার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। অথচ এটা কোনভাবেই উচিত না এবং সচেতন বাংলাদেশীর কাম্য না। আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল কিংবা ইতালী-তুরস্ক-সৌদি আরব যেই হোক না কেন, এসব পতাকা উড়ানো আইনগতভাবে নিষেধ।

এই অংশটুকু লিখার সুত্র রাকিব এরশাদ--প্রথম আলো ব্লগ 
Previous
Next Post »
Thanks for your comment